কুমিল্লা শহর থেকে ১১ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে জেলার সদর
দক্ষিণ উপজেলার বিজয়পুর ইউনিয়নের লালমাই মৌজার সালমানপুর গ্রামে কুমিল্লা
বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০ একর জায়গার বেশির ভাগই টিলা।
এই ক্যাম্পাস দেখতে প্রতিদিনই আসেন পর্যটকেরা। এক যুগে এ বিশ্ববিদ্যালয়
জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে রূপ নিয়েছে। শিগগির বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা
সম্প্রসারণের জন্য আরও ২০০ একর জায়গা অধিগ্রহণ হচ্ছে। ভূমি অধিগ্রহণ ও
উন্নয়নমূলক কাজের জন্য ১ হাজার ৬৫৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ হয়েছে। এটি
দেশের ২৫তম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে প্রথম বর্ষ প্রথম
সেমিস্টার স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে ১৪তম ব্যাচে নতুন করে আরও ১ হাজার ৪০
জন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হবে।
যাত্রা শুরুর প্রেক্ষাপট
এককালে সমৃদ্ধ জনপদ সমতট রাজ্যের প্রাণকেন্দ্র লালমাই-ময়নামতি
এলাকা। খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে চন্দ্রবংশীয় রাজা ভবদেব শালবান (আনন্দ)
বিহার প্রতিষ্ঠা করেন। তখন এটি এশিয়ার জ্ঞানচর্চার অন্যতম পাদপীঠ ছিল। ওই
বিহারকে তৎকালীন পণ্ডিতেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদায় অভিহিত করেন। তখন
পৃথিবীর বহু দেশের মানুষ ওই বিহারে জ্ঞান অন্বেষণের জন্য আসতেন। ৬৩৮ সালে
বিখ্যাত চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং শালবন বিহারে আসেন। তখন বিহারে চার
হাজার ভিক্ষু (ছাত্র) তিনি দেখতে পান। হিউয়েন সাং ময়নামতি অঞ্চলে ৩৫টি
বিহার (শিক্ষাকেন্দ্র) দেখেছেন বলে তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেন। তিনি তৎকালীন
সমতটবাসীকে (বর্তমানে কুমিল্লাবাসী) শিক্ষানুরাগী হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে ষাটের দশকে কুমিল্লা অঞ্চলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার
আন্দোলন জোরদার হয়। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও উন্নত যোগাযোগব্যবস্থার
কারণে চট্টগ্রাম বিভাগের মধ্যে কুমিল্লা জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার
জোর দাবি ওঠে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় চট্টগ্রামে। পরবর্তী
সময়ে একাধিকবার উদ্যোগ নিয়েও কুমিল্লায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব
হয়নি। অবশেষে ২০০৪ সালের ১ জুলাই কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার
প্রকল্প নেওয়া হয়। ২০০৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর
স্থাপন করা হয়। একই বছরের ৮ মে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় আইন জাতীয় সংসদে পাস
হয়। ২০০৭ সালের ২৮ মে প্রথম ব্যাচে ৭টি বিভাগে ৩০০ শিক্ষার্থী ও ১৫ জন
শিক্ষক দিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬টি
অনুষদে ১৯টি বিভাগে ৬ হাজার ২৩৫ জন শিক্ষার্থী ও ২২৭ জন শিক্ষক, ৯১ জন
কর্মকর্তা ও ১৭৫ জন কর্মচারী রয়েছেন। এর বাইরে রয়েছে সন্ধ্যাকালীন এমবিএ,
কম্পিউটার বিজ্ঞান ও কৌশল (সিএসই) এবং ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর প্রোগ্রাম।
সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞ
এদিকে বছরজুড়েই শিক্ষা কার্যক্রমের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক
কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের সরব উপস্থিতি রয়েছে। এখানে রয়েছে নাট্যসংগঠন
‘থিয়েটার কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়’, সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘প্রতিবর্তন’, আবৃত্তি
সংগঠন ‘অনুপ্রাস কণ্ঠচর্চা’, ব্যান্ড ‘প্ল্যাটফর্ম’, কুমিল্লা
ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং সোসাইটি, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ফটোগ্রাফি
সোসাইটি, সায়েন্স ক্লাব, স্বেচ্ছাসেবী রক্তদাতা সংগঠন ‘বন্ধু’, উদীচী,
প্রথম আলো বন্ধুসভা, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি ও কুমিল্লা
বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসক্লাব।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯টি বিভাগও নিয়মিত সংস্কৃতিচর্চা করে।
ভলিবলে এখানকার শিক্ষার্থীরা ভালো ফল করছেন। নৃবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক
ইসরাত জাহান বলেন, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম বাড়াতে হলে মিলনায়তন দরকার। এখানে
মিলনায়তন নেই।
শিক্ষার্থীদের চাওয়া
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে শ্রেণিকক্ষের সংকট রয়েছে। আবাসনসংকট
শিক্ষার্থীদের। নিজস্ব পরিবহনও অপ্রতুল। ছাত্ররাজনীতি ও ধূমপানমুক্ত
ক্যাম্পাস হিসেবে যাত্রা শুরু হলেও রাজনৈতিক উত্তাপ আছে। কেন্দ্রীয়
মিলনায়তন, জিমনেসিয়াম ও ভালো খেলার মাঠ নেই। ইন্টারনেটের গতি কম। ইংরেজি
বিভাগের শিক্ষার্থী আফরিন জাহান বলেন, ফাইবার অপটিক কেব্লের মাধ্যমে
দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা দরকার। গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী ইসরাত জালাল
বলেন, ছাত্রীদের জন্য নতুন হল দরকার।
এটি একটি সম্ভাবনাময় বিশ্ববিদ্যালয়। নতুন প্রকল্প বাস্তবায়িত
হলে গবেষণা, জ্ঞানচর্চার বাতিঘর হবে এই ক্যাম্পাস—এমনই মনে করেন কুমিল্লা
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কাজী ওমর সিদ্দিকী।
সব ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছি
ড. এমরান কবির চৌধুরী
উপাচার্য, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়
ড. এমরান কবির চৌধুরী
উপাচার্য, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে সব ক্ষেত্রেই শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছি। এখানে ভালো ফল অর্জনকারী মেধাবী, চৌকসদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। বিদেশের বিভিন্ন বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য শিক্ষকেরা বৃত্তি নিয়ে যাচ্ছেন। এরপর তাঁরা ফিরে আসেন। আগের চেয়ে এখন গবেষণা খাতে চার গুণ বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। এখানকার শিক্ষার্থীরা রোবট তৈরি করছেন। দ্রুত খাতা মূল্যায়ন করে দিচ্ছেন শিক্ষকেরা। যাঁরা দ্রুত খাতা মূল্যায়ন করে দেন, তাঁদের অভিনন্দনপত্র দিচ্ছি। আমরা ছেলেমেয়েদের সেশনজট কমিয়ে ফেলেছি। ছয় মাস পর আর কোনো সেশনজট থাকবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নতুন প্রকল্প এনেছি। ই-টেন্ডারে এখানে স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ হচ্ছে। নতুন ক্যাম্পাসের জন্য ২০০ একর জায়গা অধিগ্রহণ করা হচ্ছে। সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়াঙ্গনে শিক্ষার্থীরা অসামান্য অবদান রাখছেন। ভৌগোলিকভাবে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় খুবই নান্দনিক স্থানে অবস্থিত। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আমরা সেতুবন্ধ তৈরি করতে চাই। বর্তমানে ক্যাম্পাসের পাহাড়ের টিলার ফাঁকে ফাঁকে চলছে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ। নতুন প্রজন্মের জন্য কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন